ট্রেন যোদ্ধা
- মির্জা মবিন - শেষ স্মৃতি ২৮-০৪-২০২৪

এটা কোন গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধ নয়, মির্জা মবিনের সাথে ঘটে যাওয়া ট্রেন ভ্রমনের একটি অভিজ্ঞতা। যা মনে থাকবে আজীবন ও প্রথমআলোর পাঠকদের জন্য একটি সর্তকবার্তা হবে।
১২ জুলাই ২০২২ রোজ মঙ্গলবার। কুরবানির ঈদ যাত্রায় বেড়াতে যাই পর্বতীপুর, দিনাজপুর। সেখানে আমার মামা মোঃ জসিম উদ্দিন খান বাংলাদেশ রেলওয়ের কারখানা (কেলোকা) চাকরি করেন। রিটায়ার্ড করবেন আগামী বছরে সেই সুবাদে মামার আমন্ত্রণে বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে রেলযোগে জয়দেবপুর যাই। জয়দেবপুর থেকে মির্জা মবিন (আমি), মির্জা আলমগীর হোসেন (বড় ভাই) ও সানি খান (মামাতো ভাই) আমারা তিন (৩) জন পার্বতীপুরের উদ্দেশ্যে রেলযোগে রওনা হই। যাত্রাপথ দীর্ঘ থাকায় ট্রেনে চড়েই মামার বাড়িতে বেড়াতে যাই। দিনাজপুর জেলা রংপুর বিভাগের একটি জেলা এবং যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভালো থাকায় আমরা বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলোতে ভ্রমণ করি তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাজহাট জমিদার বাড়ি, সপ্নপুরী, চিকলি পার্ক সহ আরও কিছু স্থানে। খুব ভাল কেঁটেছিল দিনগুলো। বেড়ানোর দিনগুলো ফুরিয়ে এলো। ভেবেছিলাম আরও দু-একদিন থেকে যাবে কিন্তু তা আর হলো না।
১৭ জুলাই ২০২২ রোজ রবিবার বাড়ীতে আসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব। একটু হুটহাট করেই বাড়ি আসতে হচ্ছে তাই ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাটা হয়নি৷ স্টেশনে আসামাত্র খবর পেলাম সান্তাহারে গতকাল শনিবার কোনো এক ট্রেন লাইচূত হয়েছে তারজন্য ট্রেনের সময়সূচি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আমাদের ট্রেন ছিল সকালের দ্রূতযান এক্সপ্রেস।শনিবার রাত থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত ৪ টি ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও কোনটির খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। দীর্ঘক্ষণ ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার পর বিকেল ৩ টায় আসে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। বাধ্য হয়েই এই ট্রেনটিতে উঠে পড়ি। একসাথে ৪টি ট্রেনের যাত্রীরা উঠে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে।এতে অনেক ভীড় হয়ে যায়। মামা আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে যায়। মামাকে বিদায় দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি৷ ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে দীর্ঘ আড়াই ঘন্টার পথ দাঁড়িয়ে থাকি এছাড়া কোনো উপায় ছিল না৷ কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলাম ট্রেনের দরজায় সিঁড়িতে পাঁ রেখে অনেকেই বসে যাচ্ছে। তাই ক্লান্ত হয়ে আমিও ফাঁকা পেয়ে বসে যাই দরজার মুখে আর পাঁ রাখি সিঁড়িতে। দীর্ঘপথ এভাবে বসে যাচ্ছি অনেকগুলো স্টেশন পার করি। ট্রেন চলার শব্দ ও ধুলাবালিতে একটু অসস্তিবোধ করতে ছিলাম। দরজার দুই স্টিলের পাইপটা শক্ত করে ধরে রেখে মুখ একটু ভেতরের দিকে নিয়ে সিঁড়িতে দুই'পাঁ রেখে যাচ্ছিলাম।
প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলা ট্রেনটি অধিকাংশ স্টেশনে থামেনা তাই টেনে যাচ্ছিলো এবং এমনি একটি স্টেশন আসে আমার মাথা ভিতরে থাকায় খেয়াল করিনি। স্টেশনের প্লাটফর্ম একটু উঁচু এবং ট্রেনের সাথে লাগালাগি ভাবে থাকায় আমার দুইটি পাঁ, প্রথমে বাম ও পরে ডান পাঁয়ের ধক্কা লাগে। ১ সেকেন্ডের ভিতরে কোনো কিছু না বুঝার আগেই আমি আঘাত প্রাপ্ত হই। এতজোরে আমার পাঁ প্লাটফর্মের সাথে লাগে সাথে আমার ডান হাত দরজার হাতল থেকে ছুটে যায় ও আমার শরিরের অধাংশ আমার ডান পাশে বসা যাত্রীর উপরে নিক্ষিপ্ত হয়। আমার এই অবস্থা দেখে দরজায় অবস্থানরত দুইপাশের সকল যাত্রী সরে গিয়েছিল। চিৎকার করতেছিলাম বারবার বলছি “ভাই! কেউ আমাকে ধরেন, আমার পাঁ ভেঙে গেছে।” আমি বাম হতে ভর করেই আমার পুরু শরিরেকে ভিতরে নিয়ে আসি। নিচে শুয়ে পড়ি, প্রচন্ড ব্যথা করতে ছিল। ব্যাথায় পাঁ'দুটো যেন পাথর হয়েগিয়েছিল। তখন মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। মানুষের জীবন যে কত কঠিন তখন বুঝতে পাচ্ছিলাম। তখন অনেকের কথা মনে পড়তেছিলো। মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্নীয়দের ছবি চোখে ভাসছে। ট্রেনে থাকা যাত্রীরা অনেকেই অনেক প্রশ্ন করতে আমাকে। কোথায় যাবো? বাড়ী? সাথে কেউ আছে? আমি শুধু মুখ নেড়ে কথা বলতেছিলাম। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতায় বিভোর হয়ে পড়ি। মনে হচ্ছিল আমি আর বাঁচব না। মনে মনে তওবা করতেছি। কেউ পানি ঢালছে, কেউ কেলে নিয়েছে আমাকে বাতাস করছে ভিড়ের মধ্যে। আমার সাথে বড় ভাই ও মামাতো ছোট ভাই ছিল একই কামড়ার সামনের দিকে। আমার এই দুঃসংবাদ পেয়ে তারা ছুটে আসে। যখন মাথা কাজ করতে শুরু করে তখন নিজের ফোন বেড় করে আমার পরিচিত সবাইকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেই। আমার খুব খিদে পেয়েছিল তখন। মা'কে ফোন দিয়ে বলতে পাচ্ছি না কথা শুধু বলতে পেরেছিলাম আমি ব্যথা পেয়েছি।
প্রায় ২৫ মিনিট পর নাটোরে নেমে যাই। নাটোরের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল আমাকে। সেখানকার সেচ্ছাসেবী কিছু ভাইয়েরা আমাকে হেল্প করেছিল। ছাত্র অধিকার পরিষদ কিছু নেতাকর্মী আমার পাশে ছিল রাত পর্যন্ত। ডাক্তার জানায় ডান পাঁ'য়ের মোটা হাড় ভেঙে গেছে। খবর পেয়ে পার্বতীপুর থেকে মামা ও মামাতো ভাই চলে আসে। ১২ ঘন্টার মধ্যে নিটোরে নিতে যেতে। অনেক রক্ত গিয়েছিল ও ক্ষতস্থানে ইনফেকশনের ভয় ছিল। নাটোর সদর হাসপাতালে সামরিক চিকিৎসা নিয়ে রাতেই এম্বুল্যান্সে করে চলে আসি ঢাকা পঙ্গু (নিটোর) হাসপাতালে। পাশেই ফুফাতো ভাইয়ের বাসা থাকায়। সেখানে বাসায় চিকিৎসাধীন ৭ দিন অবস্থান করার পর ডাক্তার বাড়িতে পাঠানোর নির্দেশ দিলে গ্রামের বাড়ী গফরগাঁও চলে যাই। প্রায় ২ মাস বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছি।
সেপ্টেম্বর মাস পুরোটায় আমার সেমিস্টার ফাইনাল পরিক্ষা চলেছে। অনেকে জটিলতা নিয়ে আমি পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করি। ফরম ফিলাপ করাটা যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তখন একে এম খাদেমুল বাশার (চীফ ইন্সটাক্টর, ফুড টেকনোলজি, কিশোরগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট) স্যার আমাকে প্রেরণা জোগায়।

দরজার সামনে বসাটা আমার ঠিক হয়নি। হয়তো সেদিন যদি আমার পাঁ ভেঙে না গিয়ে যদি নিচে পড়ে যেতাম তাহলে হয়তো মৃত্যু ছাড়া কোনো পথ ছিল না। আমার দুই পায়ে আঘাত পেলেও আল্লাহর রহমতে ১ টি পাঁ ভেঙে গিয়েছিল। ১ মাস পরপর ডাক্তারের কাছে যাই। গত রবিবার ২৩শে অক্টোবর ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম সর্বশেষ। আলহামদুলিল্লাহ আমি এখন দাড়াতে পাচ্ছি এবং হাঁটতে পাচ্ছি৷ দেশবাসীর কাছে আমি দোয়া চাচ্ছি।

পাঠক আপনারা যারা ট্রেনে ভ্রমন করেন তারা অতি সর্কতার সাথে ভ্রমন করবেন। কেননা একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। যারা ট্রেনের দরজায় পাঁ সিঁড়ি রেখে বসেন তারা আমার এই করুণ পরিস্থিতি জেনে দয়া-করুণাসূচক সাবধান হয়ে যান। কেননা আমাদের দেশে ট্রেনে এমন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক। একটু অসতর্কতার ফলে ঘটে যায় অনেক বড় বিপদ।

লেখক,
মির্জা মবিন
গফরগাঁও, ময়মনসিংহ

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।